✍️ সৌরভ মাহাতো, পুরুলিয়া থেকে
এক সময়ের জনপ্রিয় পরিযায়ী জলপাখির আশ্রয়স্থল, পুরুলিয়ার সাহেববাঁধ আজ প্রায় মৃতপ্রায় এক জলাভূমি। শীতের প্রভাতে যেখানে শত শত জলপাখির কোলাহল মুখরিত করত চারপাশ, আজ সেখানে হাতেগোনা কিছু পাখির দেখা মেলে। গ্যাডওয়াল, নর্দার্ন শোভেলার, ফেরুজিনিয়াস ডাকের মতো একসময়ে সহজলভ্য প্রজাতিগুলি গত শীতেও একেবারে অনুপস্থিত ছিল।
পুরুলিয়া শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত এই কৃত্রিম জলাভূমিটি পুরুলিয়া পুরসভা দ্বারা পরিচালিত হলেও এখন এর পরিবেশগত অবস্থা চরম সংকটজনক। সম্প্রতি জলাভূমি পরিদর্শনে গিয়ে এনজিও WINGS-এর আর্কজ্যোতি মুখার্জি জানান, “জলাশয়ের উপর ভেসে থাকা অসংখ্য মৃত মাছ ছিল পরিবেশ বিপর্যয়ের স্পষ্ট ইঙ্গিত। জলের মধ্যে দ্রবীভূত অক্সিজেনের মাত্রা কমে যাওয়ায় জৈবপদার্থের পচনের ফলে একধরনের পচা দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে। এটি ইঙ্গিত দেয় যে, অপরিশোধিত নিকাশিনিষ্কাশন, ইউট্রোফিকেশন, জলজ উদ্ভিদের অপব্যবস্থাপনা ও মানব হস্তক্ষেপ এই জলাভূমির জীববৈচিত্র্যকে বিপন্ন করে তুলেছে।”
মুখার্জি বর্তমানে IIT খড়গপুর-এ অধ্যাপক গৌরব ধর ভৌমিকের তত্ত্বাবধানে Anusandhan National Research Foundation (GoI)-এর National Post-Doctoral Fellowship অর্জন করে সাহেববাঁধ ও আদ্রা সাহেববাঁধের জলাভূমি পরিবেশ নিয়ে গবেষণা করছেন।
তিনি জানান, “সাহেববাঁধ পূর্ব এশিয়া-অস্ট্রেলেশিয়া এবং মধ্য এশিয়া ফ্লাইওয়ের মিলনস্থলে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিযায়ী পাখির আশ্রয়স্থল ছিল। কিন্তু শহরায়নের প্রভাবে জলাভূমির স্বাভাবিক বাস্তুসংস্থান ভেঙে পড়েছে।”
২০১৩-১৪ থেকে ২০১৯-২০ সাল পর্যন্ত মুখার্জির করা মাঝ-শীতকালের সমীক্ষা অনুযায়ী, জলপাখির সংখ্যা ৩৭১৮ (± ২৪১.২) থেকে কমে ১৬৩ (± ৩৮.৫)-এ নেমে আসে। প্রজাতির বৈচিত্র্যও ৫৯ থেকে কমে দাঁড়ায় মাত্র ১৭। তার পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, ২৭টি পাখির প্রজাতির জনসংখ্যায় পরিসংখ্যানগতভাবে উল্লেখযোগ্য হ্রাস ঘটেছে — যার মধ্যে আটটি প্রজাতি মারাত্মক হ্রাস এবং বাকি ১৯টি উল্লেখযোগ্য হ্রাসের মুখে।
মানব বসতির বিস্তার এবং কৃষিজমির হারিয়ে যাওয়া — যা ছিল পাখিদের রাতের খাবারের গুরুত্বপূর্ণ উৎস — এর সাথে সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে পাখির সংখ্যার পতনের। পাশাপাশি, জলজ উদ্ভিদ ব্যবস্থাপনায় চরম অব্যবস্থাপনা, বিশেষ করে জলজ জলজ উদ্ভিদের (যেমন, জলাকাদম্ব) অনিয়ন্ত্রিত বৃদ্ধি ও অপসারণ, আবাসস্থলের গুণগত মান এবং খাদ্যের প্রাপ্যতা কমিয়ে দিয়েছে।
২০২৪ সালের শীতকালে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। ওই সময়ে মাত্র ১১টি প্রজাতি দেখা গেছে এবং মোট পাখির সংখ্যা ছিল মাত্র ৬০-৭০। তবে কাছাকাছি অবস্থিত আদ্রা সাহেববাঁধ এখনও পরিযায়ী জলপাখির একটি স্থিতিশীল আশ্রয়স্থল হিসেবে রয়ে গেছে।
এই সংকট থেকে উত্তরণের পথও দেখিয়েছেন মুখার্জি। তার মতে, জলাশয়ের পুনরুদ্ধারের জন্য অবিলম্বে পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি — যেমন, বর্জ্যজল ব্যবস্থাপনা, জলজ উদ্ভিদের পুনঃস্থাপন, স্থানীয় সম্প্রদায়ের সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং দক্ষ প্রশাসনিক তদারকি।
তবে পুরুলিয়া পুরসভার চেয়ারম্যান নবেন্দু মাহালি-র সঙ্গে যোগাযোগের বহু চেষ্টা করেও কোনও প্রতিক্রিয়া মেলেনি।
সাহেববাঁধে পরিযায়ী পাখির কোলাহল আবার ফিরবে কি? নাকি আমরা আরও এক জলাভূমিকে হারাতে চলেছি — ইতিহাসের নীরব অধ্যায়ে? সময়ের অপেক্ষা।