জঙ্গলমহলের পরিযায়ী শ্রমিক/অভিবাসন সমস্যা: কেন্দ্র, রাজ্য ও স্থানীয় নেতৃত্বের ব্যর্থতা এবং সমাধানের পথ

জঙ্গলমহল, পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিমাঞ্চলের একটি বিশাল ভূখণ্ড, যেখানে পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, পশ্চিম মেদিনীপুর এবং ঝাড়গ্রাম জেলাগুলি অবস্থিত। এই অঞ্চলটি তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, জনজাতি সংস্কৃতি এবং সমৃদ্ধ বনজ সম্পদের জন্য পরিচিত। কিন্তু এই সৌন্দর্যের আড়ালে লুকিয়ে আছে এক গভীর সংকট—অভিবাসনের সমস্যা। জঙ্গলমহলের অধিকাংশ তরুণ-তরুণী এবং শ্রমিকরা জীবিকার সন্ধানে অন্য রাজ্যে পাড়ি দিচ্ছেন। এই অভিবাসন শুধুমাত্র অর্থনৈতিক নয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষতিও ডেকে আনছে। এই সমস্যার মূলে রয়েছে কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের উদাসীনতা, স্থানীয় নেতৃত্বের ব্যর্থতা এবং পরিকল্পনার অভাব।

কেন্দ্রীয় সরকারের ব্যর্থতা

কেন্দ্রীয় সরকার জঙ্গলমহলের উন্নয়নের জন্য বড় বড় প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বটে, কিন্তু বাস্তবে তার ফলাফল অত্যন্ত নগণ্য। এই অঞ্চলের জনজাতি সম্প্রদায়ের জন্য বিশেষ প্রকল্প এবং বিনিয়োগের কথা বলা হয়, কিন্তু বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে তা প্রায় অদৃশ্য। উদাহরণস্বরূপ, মহাত্মা গান্ধী জাতীয় গ্রামীণ কর্মসংস্থান গ্যারান্টি আইন (MGNREGA) জঙ্গলমহলের গ্রামীণ শ্রমিকদের জন্য একটি সম্ভাবনা ছিল, কিন্তু এই প্রকল্পে বরাদ্দ তহবিলের অভাব এবং সময়মতো মজুরি প্রদানে বিলম্বের কারণে এটি কার্যকরভাবে ব্যর্থ হয়েছে। কেন্দ্রের তথাকথিত “অভিবাসন নিয়ন্ত্রণ” নীতিগুলি কেবল কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ, এবং অভিবাসী শ্রমিকদের সুরক্ষা ও পুনর্বাসনের জন্য কোনো সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নেই। এই উদাসীনতা জঙ্গলমহলের মানুষকে বাধ্য করছে তাদের গ্রাম ছেড়ে অন্যত্র জীবিকার সন্ধানে যেতে।

রাজ্য সরকারের উদাসীনতা

রাজ্য সরকারের ভূমিকাও সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়। পশ্চিমবঙ্গ সরকার জঙ্গলমহলের উন্নয়নের জন্য পশ্চিমাঞ্চল উন্নয়ন পরিষদ গঠন করেছে, কিন্তু এই প্রকল্পগুলি প্রায়শই রাজনৈতিক প্রচারের হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। স্থানীয় শিল্প গড়ে তোলা, কৃষি-ভিত্তিক অর্থনীতিকে শক্তিশালী করা, বা জনজাতি সম্প্রদায়ের জন্য দক্ষতা উন্নয়নের প্রশিক্ষণের মতো পদক্ষেপগুলি অপর্যাপ্ত। রাজ্য সরকারের দাবি, তারা অভিবাসী শ্রমিকদের জন্য স্থানীয় কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করছে, কিন্তু বাস্তবে এই প্রচেষ্টা অত্যন্ত সীমিত। উদাহরণস্বরূপ, ২০২০ সালে মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেছিলেন যে অভিবাসী শ্রমিকদের জন্য স্থানীয় কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হবে, কিন্তু পাঁচ বছর পরেও সেই প্রতিশ্রুতি অধরা। এই অঞ্চলের যুবকরা এখনও কেরালা, কর্ণাটক বা মুম্বইয়ের মতো দূরবর্তী শহরে কম মজুরিতে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন।

স্থানীয় নেতৃত্বের অক্ষমতা

স্থানীয় নেতৃত্বের ব্যর্থতা জঙ্গলমহলের অভিবাসন সমস্যাকে আরও জটিল করেছে। পঞ্চায়েত নেতা এবং স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা প্রায়শই নিজেদের স্বার্থে ব্যস্ত থাকেন, জনগণের সমস্যা সমাধানে তাদের ভূমিকা অত্যন্ত সীমিত। জঙ্গলমহলের গ্রামগুলিতে শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং কর্মসংস্থানের মতো মৌলিক সুযোগ-সুবিধার অভাব রয়েছে। স্থানীয় নেতারা সরকারি প্রকল্পগুলির সুবিধা নিজেদের অনুগতদের মধ্যে বিতরণ করেন, ফলে সাধারণ মানুষ উপেক্ষিত থেকে যান। এছাড়া, অভিবাসী শ্রমিকদের সমস্যা, যেমন শোষণ, নিরাপত্তাহীনতা এবং ন্যায্য মজুরির অভাব, নিয়ে স্থানীয় নেতৃত্ব কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেয় না। এই অক্ষমতা এবং উদাসীনতা জঙ্গলমহলের মানুষের মধ্যে হতাশা এবং অসন্তোষ বাড়িয়ে তুলছে।

সমাধানের পথ

জঙ্গলমহলের অভিবাসন সমস্যা সমাধানের জন্য একটি সামগ্রিক এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রয়োজন। নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলি এই সংকট মোকাবিলায় সাহায্য করতে পারে:

১. স্থানীয় শিল্পায়ন ও কর্মসংস্থান: জঙ্গলমহলের প্রাকৃতিক সম্পদ এবং কৃষি সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে ছোট-বড় শিল্প গড়ে তোলা প্রয়োজন। কৃষি-ভিত্তিক শিল্প, হস্তশিল্প এবং পর্যটন শিল্পে বিনিয়োগ স্থানীয় যুবকদের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারে।

২. শিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়ন: জঙ্গলমহলের যুবকদের জন্য বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ এবং দক্ষতা উন্নয়ন প্রকল্প চালু করতে হবে। এটি তাদের শুধুমাত্র স্থানীয়ভাবে কাজ পেতে সাহায্য করবে না, বরং অন্য শহরে গেলেও তাদের শোষণের হাত থেকে রক্ষা করবে।

৩. MGNREGA-র কার্যকর বাস্তবায়ন: MGNREGA-র মতো প্রকল্পগুলিকে আরও স্বচ্ছ এবং কার্যকর করতে হবে। সময়মতো মজুরি প্রদান এবং প্রকল্পের সঠিক ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা গেলে গ্রামীণ শ্রমিকরা স্থানীয়ভাবে কাজ পাবেন।

৪. অভিবাসী শ্রমিকদের সুরক্ষা: যারা ইতিমধ্যে অন্য রাজ্যে কাজ করছেন, তাদের জন্য সামাজিক সুরক্ষা, স্বাস্থ্য বীমা এবং আইনি সহায়তার ব্যবস্থা করতে হবে। এটি তাদের শোষণ এবং অনিশ্চয়তা থেকে রক্ষা করবে।

৫. স্থানীয় নেতৃত্বের জবাবদিহিতা: পঞ্চায়েত এবং স্থানীয় নেতাদের কার্যক্রমে স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। জনগণের সমস্যা সমাধানে তাদের সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে।

** জঙ্গলমহলের অভিবাসন সমস্যা কেবল অর্থনৈতিক নয়, এটি একটি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংকট। কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের উদাসীনতা এবং স্থানীয় নেতৃত্বের অক্ষমতা এই সমস্যাকে আরও গভীর করেছে। এই অঞ্চলের মানুষ তাদের নিজের মাটিতে সম্মানের সঙ্গে বাঁচার অধিকার রাখে। তাই প্রয়োজন সরকারি নীতির সংস্কার, স্থানীয় উদ্যোগের প্রসার এবং সকল স্তরে সমন্বিত প্রচেষ্টা। জঙ্গলমহলের সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে এই অঞ্চলকে শুধু জীবিকার নয়, সমৃদ্ধির একটি কেন্দ্রে পরিণত করা সম্ভব। কিন্তু তার জন্য দরকার সত্যিকারের ইচ্ছাশক্তি এবং দায়িত্বশীল নেতৃত্ব।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *