বাংলার দ্বিচারিতা: তরুণজ্যোতি তেওয়ারি এবং মানভূমের কুড়মিদের প্রশ্নে

ফেসবুকে একটি প্রোফাইল ঘিরে হইচই পড়ে গেছে, নাম কট্টর বাঙালি তরুণজ্যোতি তেওয়ারি। কেউ হয়তো মজা করে বানিয়েছে, কেউ হয়তো তা‌র জাতীয় পরিচয় নিয়ে গর্বিত, কেউ হয়তো প্রহসনের ছলে সমাজকে আয়না ধরেছে। কিন্তু যেভাবে কিছু বাঙালি এই নাম নিয়ে প্রশ্ন তুলছে — “তরুণজ্যোতি তেওয়ারি কীভাবে কট্টর বাঙালি হতে পারে?” — তাতে এই সমাজের স্বরূপ অনেকটাই নগ্ন হয়ে পড়ছে। তারা যেন ধরে নিয়েছে যে, তেওয়ারি পদবি মানেই অবাঙালি, হিন্দিভাষী, বহিরাগত। অথচ সেই লোক যদি নিজের পরিচয়কে বাঙালিয়ানায় রাঙাতে চায়, তবে সে যেন অপরাধ করে ফেলেছে।

এই প্রশ্ন তোলা মানুষগুলোই কিন্তু তখন চুপ করে ছিলেন, যখন ১৯৫৬ সালের ১ নভেম্বর মানভূম জেলার বুক চিরে পুরুলিয়াকে বাংলায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ঐতিহাসিক সত্য বলছে — পুরুলিয়া সেই সময়ে ছিল একটি উপজাতি ও কুড়মি-আধিক্যপূর্ণ এলাকা। সাঁওতাল, মুণ্ডা, ভূমিজ, কুড়মি, ওরাওঁ প্রভৃতি জাতিগোষ্ঠী ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ। তাদের ভাষা ছিল কুড়ুখ, কুড়মালি, সাঁওতালি বা স্থানীয় ভাষা। কিন্তু প্রশাসনিক কৌশলে এই উপজাতিদেরই কাগজে-কলমে বাঙালি হিসেবে উপস্থাপন করে পুরুলিয়াকে বাংলায় টেনে আনা হয়েছিল। যে কুড়মি লোকটি তখন কুড়মালি ভাষায় গান গাইতেন, তাঁকেও বলা হয়েছিল তিনি বাঙালি। আর আজ সেই কুড়মি সন্তান যদি নিজের নামের পাশে ‘কট্টর বাঙালি’ লেখে, তখন কিছু শিক্ষিত বাঙালি জাতীয়তাবাদী চোখরাঙিয়ে প্রশ্ন করে — তেওয়ারি কবে থেকে বাঙালি হলো?

বাঙালির এই দ্বিচারিতা আসলে এক দীর্ঘ ঐতিহাসিক প্রবণতা। যখন দরকার হয়, তখন তারা সংখ্যাগরিষ্ঠতা দেখাতে উপজাতিদেরকে বাঙালি সাজিয়ে নেয়, আর যখন নিজের জাতীয় স্বাতন্ত্র্য রক্ষার প্রশ্ন আসে, তখন সেই উপজাতিদেরকেই খুঁজে বের করে বলে:- এরা তো আসলে অন্য ভাষাভাষী, অন্য সংস্কৃতির। এই বাছবিচার শুধু রাজনীতির জন্য নয়, বরং সাংস্কৃতিক দখলদারিত্বের অংশও বটে।
তরুণজ্যোতি তেওয়ারি নামটা শুধু একটি নাম নয়, বরং এটি এক বিদ্রোহী প্রশ্নচিহ্ন। এটি আমাদের মুখের ওপর থাপ্পড় মারে, বলে- তোমরা যখন স্বার্থে বাঙালি করো, তখন ঠিক আছে, কিন্তু যখন কেউ নিজের ইচ্ছায় বাঙালি হতে চায়, তখন তা মেনে নিতে পারো না কেন?

আমরা ভুলে যাই, ভাষা ও সংস্কৃতি রক্তের বিষয় নয়, অনুভবের বিষয়। বাঙালিয়ানা যদি রবীন্দ্রসঙ্গীত, মাছ-ভাত, দুর্গাপূজা, সত্তরের রাজনীতি, কিংবা ছাতিমতলায় বসে চিন্তা করার মানসিকতা হয়, তবে সেটা যে কেউ গ্রহণ করতেই পারে। তেওয়ারি পদবি কোনও দেয়াল নয়, বরং হয়তো একজন নতুন বাঙালির সূচনা।

এই লেখা তাই শুধু তরুণজ্যোতি তেওয়ারিকে নয়, বরং সমাজের সমস্ত নতুন বাঙালিকে সমর্থন জানায় – যারা হৃদয়ে বাঙালি হতে চায়, মননে বাঙালি হতে চায়, সাহসে বাঙালি হতে চায়। তেমনি কুড়মি, সাঁওতাল, ভূমিজ, ওরাওঁ – যাঁদের নাম জাতীয় তালিকায় লেখা আছে, তাঁদের কৃতিত্বে এই পুরুলিয়া বাংলা হয়েছে, তা আজ স্বীকার করার সময় হয়েছে। আজ ভজহরি মাহাতো বেঁচে থাকলে বুঝতেন, কী ভয়ানক ভুল তিনি করেছিলেন — হয়তো দাশগুপ্তদের ছলনায়, প্রতারণায়। তিনি ভেবেছিলেন, বঙ্গভূমিতে প্রবেশ মানে হবে বৃহত্তর মর্যাদা, আত্মমর্যাদার প্রতিষ্ঠা।

বাঙালিত্ব কোনও সীমিত গণ্ডির নাম নয়। সেটা একটা জীবন্ত সংস্কৃতি। আর জীবন্ত জিনিস কখনও জোর করে রক্ষা করা যায় না, বরং তাকে খুলে দিতে হয় সকলের জন্য। এই সত্যকে স্বীকার না করলে, বাঙালির শ্রেষ্ঠত্ব শুধু অহংকারেই সীমাবদ্ধ থেকে যাবে। তা আর কখনও মানবিক হবে না, কেবল জাতীয়তা-আবদ্ধ গর্বের খাঁচায় বন্দি হয়ে থাকবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *