মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনৈতিক মঞ্চে ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে চলমান সংঘাত একটি বিস্ফোরক পরিস্থিতির জন্ম দিয়েছে, যা বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। ২০২৫ সালের ১৩ জুন থেকে শুরু হওয়া এই যুদ্ধ, যার কোডনাম ইসরায়েলের পক্ষ থেকে “অপারেশন রাইজিং লায়ন”, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি বন্ধ করার লক্ষ্যে ইসরায়েলের ব্যাপক বিমান হামলার মাধ্যমে শুরু হয়। এরপর ইরানের প্রতিশোধমূলক হামলা “অপারেশন ট্রু প্রমিস III” এই সংঘাতকে আরও উত্তপ্ত করেছে। এই যুদ্ধ শুধুমাত্র দুই দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মতো মহাশক্তিগুলোর সম্পৃক্ততার সম্ভাবনা এবং তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আশঙ্কা তৈরি করছে। এই নিবন্ধে আমরা এই সংঘাতের বর্তমান অবস্থা, মহাশক্তিগুলোর সম্ভাব্য ভূমিকা এবং বিশ্বযুদ্ধের সম্ভাবনা বিশ্লেষণ করব।
ইরান-ইসরায়েল সংঘাত: বর্তমান পরিস্থিতি
ইসরায়েলের হামলা ইরানের পারমাণবিক স্থাপনা, সামরিক ঘাঁটি এবং গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোকে লক্ষ্য করে শুরু হয়। ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু দাবি করেছেন, এই হামলার উদ্দেশ্য ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির সম্ভাবনা রোধ করা। তিনি ইরানের জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন, তাদের “দমনকারী শাসন” থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য এই হামলা একটি পথ প্রশস্ত করছে। ইসরায়েলের এফ-৩৫আই স্টিলথ ফাইটার জেট এবং মোসাদের গোয়েন্দা কার্যক্রম এই অভিযানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে, যার মধ্যে তেহরানের কাছে গোপন ড্রোন ঘাঁটি স্থাপন এবং ইরানের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নিষ্ক্রিয় করা উল্লেখযোগ্য।
ইরান, প্রতিক্রিয়া হিসেবে, ব্যালিস্টিক মিসাইল এবং ড্রোন দিয়ে ইসরায়েলের সামরিক ও বেসামরিক লক্ষ্যবস্তুতে পাল্টা হামলা চালিয়েছে। ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই হামলাগুলোকে “যুদ্ধের ঘোষণা” হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। তেহরান, তাবরিজ, শিরাজ এবং নাতাঞ্জের মতো শহরগুলোতে বিস্ফোরণের খবর পাওয়া গেছে, যেখানে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে, ইরানের ফোর্ডো পারমাণবিক স্থাপনা, যা পাহাড়ের গভীরে অবস্থিত, এখনও অক্ষত রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। ইরানের বিশাল মিসাইল মজুদ এবং প্রক্সি গোষ্ঠীগুলোর (যেমন হিজবুল্লাহ, হুথি) সক্রিয়তা এই সংঘাতকে আরও জটিল করে তুলেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য সম্পৃক্ততা
যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা এই সংঘাতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইসরায়েলের দীর্ঘদিনের মিত্র হিসেবে, যুক্তরাষ্ট্র ইতিমধ্যেই ইসরায়েলকে গোয়েন্দা তথ্য, প্রতিরক্ষা সহায়তা এবং বাঙ্কার-বাস্টার বোমা সরবরাহ করেছে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও প্রাথমিকভাবে দাবি করেছিলেন যে এই হামলা ইসরায়েলের একতরফা সিদ্ধান্ত, কিন্তু প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প পরবর্তীতে স্বীকার করেছেন যে তিনি এই অভিযান সম্পর্কে পূর্বেই অবগত ছিলেন।
যুক্তরাষ্ট্রের সম্পৃক্ততার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায় যদি ইরান মার্কিন ঘাঁটি বা কূটনৈতিক স্থাপনাগুলোতে হামলা চালায়। ইরানের হাজার হাজার ব্যালিস্টিক মিসাইল এবং ড্রোন বাহরাইন, কুয়েত, কাতার এবং সৌদি আরবে অবস্থিত মার্কিন ঘাঁটিগুলোর জন্য হুমকি। ২০২০ সালে ইরানের কুদস ফোর্সের কমান্ডার কাসেম সোলাইমানির হত্যার পর ইরান মার্কিন ঘাঁটিতে হামলা চালিয়েছিল, এবং এই ধরনের হামলার পুনরাবৃত্তি সম্ভব।
ট্রাম্পের নীতি এই সংঘাতে একটি বিশৃঙ্খল চিত্র উপস্থাপন করে। তিনি একদিকে শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, অন্যদিকে ইসরায়েলের হামলাকে “চমৎকার” বলে প্রশংসা করেছেন। তবে, তিনি স্পষ্টভাবে সরাসরি সামরিক হস্তক্ষেপের বিষয়ে নীরব রয়েছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট্রাল কমান্ড (CENTCOM) ইতিমধ্যেই মধ্যপ্রাচ্যে অতিরিক্ত যুদ্ধবিমান এবং বিমানবাহী জাহাজ মোতায়েন করেছে, যা একটি সম্ভাব্য সংঘাতের জন্য প্রস্তুতির ইঙ্গিত দেয়।
রাশিয়ার সম্ভাব্য ভূমিকা
রাশিয়া ইরানের একটি গুরুত্বপূর্ণ মিত্র, এবং ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ইরান রাশিয়ার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সামরিক সরবরাহকারী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। ইরান রাশিয়াকে ড্রোন, ব্যালিস্টিক মিসাইল এবং যুদ্ধবিমান সরবরাহ করছে। ইসরায়েলের হামলার ফলে ইরানের শাসনব্যবস্থার পতন হলে, রাশিয়া তার একটি গুরুত্বপূর্ণ মিত্র হারাবে, যা মস্কোর জন্য কৌশলগত ক্ষতি।
রাশিয়ার উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা, যেমন কনস্টান্টিন কোসাচেভ, ইসরায়েলের হামলার তীব্র নিন্দা করেছেন এবং এটিকে “আইনি, রাজনৈতিক, সামরিক বা নৈতিকভাবে ন্যায্য” নয় বলে বর্ণনা করেছেন। তারা সতর্ক করেছেন যে এই সংঘাত পুরো মধ্যপ্রাচ্যে ছড়িয়ে পড়তে পারে এবং এমনকি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের দিকে নিয়ে যেতে পারে। রাশিয়া ইরানকে আরও বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এবং সামরিক সহায়তা সরবরাহ করতে পারে, যা এই সংঘাতকে আরও জটিল করবে।
তবে, রাশিয়ার বর্তমান অবস্থান ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে দুর্বল। রাশিয়ার সামরিক সম্পদ ইউক্রেনে নিয়োজিত, এবং এটি মধ্যপ্রাচ্যে সরাসরি সামরিক হস্তক্ষেপের জন্য পর্যাপ্ত শক্তি নাও থাকতে পারে। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এই সংঘাতের কূটনৈতিক সমাধানের জন্য মধ্যস্থতার প্রস্তাব দিয়েছেন, তবে এটি এখনও কার্যকর হয়নি।
তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সম্ভাবনা
ইরান-ইসরায়েল সংঘাত তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের দিকে নিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে বিশ্বজুড়ে আলোচনা চলছে। সামাজিক মাধ্যমে, বিশেষ করে এক্স প্ল্যাটফর্মে, “World War 3” বিষয়টি ট্রেন্ডিং হয়েছে, যা জনগণের মধ্যে উদ্বেগের প্রতিফলন। তবে, বিশেষজ্ঞরা মনে করেন যে এই সংঘাত এখনও পুরোদস্তুর বিশ্বযুদ্ধে রূপ নেয়নি।
প্রথমত, ইরান এবং ইসরায়েল উভয়ই সরাসরি পূর্ণমাত্রার যুদ্ধ এড়াতে চাইছে। ইরানের কৌশল প্রক্সি যুদ্ধ এবং সীমিত হামলার উপর নির্ভরশীল, যখন ইসরায়েল তার উন্নত বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এবং গোয়েন্দা নেটওয়ার্কের মাধ্যমে সুনির্দিষ্ট হামলার উপর জোর দিচ্ছে।
দ্বিতীয়ত, যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়া উভয়ই সরাসরি সামরিক সংঘাতে জড়াতে অনিচ্ছুক। ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিল “চিরস্থায়ী যুদ্ধ” এড়ানো, এবং পুতিন ইউক্রেন যুদ্ধে ব্যস্ত। তবে, যদি ইরান মার্কিন লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালায় বা রাশিয়া ইরানকে পারমাণবিক অস্ত্র সরবরাহ করে, তবে পরিস্থিতি দ্রুত বদলে যেতে পারে।
তৃতীয়ত, এই সংঘাত যদি মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশ, যেমন সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত বা তুরস্ককে জড়িয়ে ফেলে, তবে এটি একটি আঞ্চলিক যুদ্ধে রূপ নিতে পারে। ইরানের হরমুজ প্রণালী বন্ধ করার হুমকি তেলের বৈশ্বিক সরবরাহকে ব্যাহত করতে পারে, যা অর্থনৈতিক সংকট সৃষ্টি করবে এবং বিশ্ব শক্তিগুলোকে হস্তক্ষেপে বাধ্য করতে পারে।
ইরান-ইসরায়েল সংঘাত বিশ্বকে একটি বিপজ্জনক মোড়ে নিয়ে এসেছে। যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়ার সম্পৃক্ততার সম্ভাবনা এই সংকটকে আরও জটিল করে তুলেছে। তবে, বর্তমানে এটি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধে রূপ নেওয়ার সম্ভাবনা সীমিত, কারণ উভয় পক্ষই সরাসরি সংঘাত এড়াতে চাইছে এবং মহাশক্তিগুলোর নিজস্ব সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তবুও, এই সংঘাতের ফলাফল বিশ্বের ভূ-রাজনৈতিক ভারসাম্যকে পুনর্নির্মাণ করতে পারে। এই পরিস্থিতিতে কূটনৈতিক সমাধান এবং সংযমই হতে পারে শান্তির একমাত্র পথ।
বিশ্ব এখন শ্বাসরুদ্ধ করে দেখছে, এই সংঘাত কোন পথে এগোবে। এটি কি শান্তির দিকে মোড় নেবে, নাকি বিশ্বকে আরও গভীর সংকটের দিকে ঠেলে দেবে? সময়ই এর উত্তর দেবে।