পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষা ব্যবস্থা একসময় দেশের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ ছিল। কিন্তু বর্তমান তৃণমূল কংগ্রেস সরকারের আমলে এই ব্যবস্থা ক্রমশ ধ্বংসের মুখে পড়ছে। সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টের রায়ে ২৬,০০০ শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীর নিয়োগ বাতিল হয়েছে, যা ২০১৬ সালে স্কুল সার্ভিস কমিশন (SSC) দ্বারা নিয়োগ প্রক্রিয়ায় ব্যাপক দুর্নীতির কারণে ঘটেছে। এই ঘটনা শুধু শিক্ষকদের জীবনে সংকট নিয়ে এসেছে তা নয়, বরং রাজ্যের সরকারি শিক্ষা ব্যবস্থার ভিত্তিকে আরও দুর্বল করে দিয়েছে। এর পাশাপাশি, যুব সমাজের একটি বড় অংশ পড়াশোনা ও দক্ষতা উন্নয়নের পরিবর্তে অর্থহীন রিল ভিডিও তৈরি এবং ফুড ব্লগিংয়ের দিকে ঝুঁকছে। এই পরিস্থিতি আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য কতটা বিপজ্জনক, তা নিয়ে আলোচনা করা জরুরি।
শিক্ষা ব্যবস্থার ধ্বংস: সরকারের ভূমিকা
পশ্চিমবঙ্গ সরকারের শিক্ষা ব্যবস্থা বহু বছর ধরে শিক্ষকের অভাব, অবকাঠামোর দুর্বলতা এবং দুর্নীতির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ২০১৬ সালে SSC-র নিয়োগ প্রক্রিয়ায় ২৩ লক্ষ প্রার্থী ২৪,৬৪০টি পদের জন্য প্রতিযোগিতা করেছিল। কিন্তু দুর্নীতি, OMR শিটে কারচুপি এবং অযোগ্য প্রার্থীদের নিয়োগের কারণে ২৫,৭৫৩ জনের চাকরি বাতিল করা হয়েছে। এই ঘটনা প্রমাণ করে যে সরকার শিক্ষার মানোন্নয়নের পরিবর্তে দুর্নীতির পথ বেছে নিয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ব্যক্তিগতভাবে এই রায় মানতে না চাইলেও, তিনি এই দুর্নীতির দায় এড়াতে পারেন না।
বহু স্কুলে শিক্ষকের সংখ্যা ইতিমধ্যেই কম ছিল। এখন ২৬,০০০ শিক্ষকের চাকরি বাতিল হওয়ায় স্কুলগুলোর পঠনপাঠন ব্যাহত হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, মুর্শিদাবাদের শৈলজা মেমোরিয়াল গার্লস হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা কাকলি চৌধুরী বলেছেন, “আমার সায়েন্স ফ্যাকাল্টি প্রায় পুরোপুরি চলে গেছে। কীভাবে ক্লাস চালাব?” এই পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয়ে পড়ছে।
২৬,০০০ শিক্ষক নিয়োগ বাতিলের প্রভাব
এই রায় শুধু শিক্ষকদের জন্যই নয়, ছাত্র-ছাত্রী এবং অভিভাবকদের জন্যও একটি বড় ধাক্কা। অনেক শিক্ষক, যারা কঠোর পরিশ্রম করে চাকরি পেয়েছিলেন, তারা এখন বেকার। একজন শিক্ষিকা এমনকি চাকরি হারানোর পর আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন, যা এই সংকটের ব্যক্তিগত মাত্রাকে তুলে ধরে। স্কুলগুলোতে শিক্ষকের অভাবে পড়াশোনার মান কমছে, এবং মাধ্যমিক পরীক্ষার উত্তরপত্র পরীক্ষা করার মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজও ব্যাহত হচ্ছে। এর ফলে শিক্ষার্থীরা স্কুল ছেড়ে শ্রমিকের কাজে যোগ দিচ্ছে, যা রাজ্যের শিক্ষার ভবিষ্যৎকে আরও সংকটে ফেলছে।
যুব সমাজের ভুল পথে যাত্রা
এই শিক্ষা সংকটের মধ্যে যুব সমাজের একটি বড় অংশ পড়াশোনা এবং দক্ষতা উন্নয়নের পরিবর্তে অর্থহীন রিল ভিডিও তৈরি এবং ফুড ব্লগিংয়ের দিকে ঝুঁকছে। সোশ্যাল মিডিয়ার প্রভাবে তারা দ্রুত খ্যাতি ও অর্থের লোভে এই পথ বেছে নিচ্ছে। কিন্তু এই কাজগুলো কতদিন টিকবে? একটি অর্থহীন রিল ভিডিও, রোস্ট ভিডিও বা ফুড ব্লগ দিয়ে কি সত্যিই একটি স্থায়ী ও সম্মানজনক জীবন গড়া সম্ভব? শিক্ষা ও দক্ষতা ছাড়া এই যুবক-যুবতীরা ভবিষ্যতে বেকারত্ব ও হতাশার মুখোমুখি হবে।
সরকারি শিক্ষা ব্যবস্থার এই দুরবস্থা যুবকদের মনে একটি বার্তা দিচ্ছে—পড়াশোনা করে লাভ নেই। ফলে তারা দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্যের পরিবর্তে স্বল্পমেয়াদী জনপ্রিয়তার পিছনে ছুটছে। এটি শুধু ব্যক্তিগত ক্ষতি নয়, সমাজ ও রাজ্যের জন্যও একটি বড় হুমকি।
যুব সমাজের জন্য করণীয় ও বর্জনীয়
ভবিষ্যতে একটি সম্মানজনক ও স্থায়ী জীবন গড়তে যুবক-যুবতীদের কিছু নিয়ম মেনে চলা জরুরি। এখানে কিছু করণীয় ও বর্জনীয় উল্লেখ করা হলো:
করণীয়:
- শিক্ষাকে প্রাধান্য দিন: শিক্ষা আপনার ভবিষ্যতের ভিত্তি। স্কুল বা কলেজ ছেড়ে না দিয়ে পড়াশোনায় মন দিন।
- দক্ষতা উন্নয়ন করুন: কম্পিউটার, ভাষা শিক্ষা, বা অন্য কোনো ব্যবহারিক দক্ষতা শিখুন, যা চাকরি পেতে সাহায্য করবে।
- দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্য নির্ধারণ করুন: স্বল্পমেয়াদী খ্যাতির পরিবর্তে এমন একটি ক্যারিয়ার বেছে নিন যা আপনাকে স্থায়ী সাফল্য দেবে।
- সময়ের সঠিক ব্যবহার করুন: সোশ্যাল মিডিয়ায় সময় নষ্ট না করে বই পড়ুন, ওয়েবিনারে অংশ নিন, বা নতুন কিছু শিখুন।
- সচেতন নাগরিক হোন: সরকারের ভুল নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করুন এবং শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নতির জন্য সোচ্চার হোন।
বর্জনীয়:
- অর্থহীন রিল তৈরি করবেন না: এটি আপনার সময় ও প্রতিভা নষ্ট করে এবং দীর্ঘমেয়াদে কোনো লাভ দেয় না।
- দ্রুত খ্যাতির পিছনে ছুটবেন না: ফুড ব্লগিং বা এই ধরনের কাজে সাফল্য পেতে দক্ষতা ও পরিকল্পনা লাগে, শুধু লোভে এতে ঝাঁপবেন না।
- শিক্ষাকে অবহেলা করবেন না: শিক্ষা ছাড়া জীবনে স্থায়ী সাফল্য অসম্ভব।
- অনৈতিক পথ বেছে নেবেন না: দুর্নীতি বা শর্টকাটে সাফল্যের চেষ্টা করবেন না, এটি শেষ পর্যন্ত ক্ষতি করে।
- হতাশ হবেন না: সরকারি ব্যবস্থার দুর্বলতা দেখে নিজের লক্ষ্য থেকে সরে যাবেন না।
উপসংহার
পশ্চিমবঙ্গ সরকারের শিক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংসের পথে এগোচ্ছে, এবং ২৬,০০০ শিক্ষকের নিয়োগ বাতিল এটির একটি জ্বলন্ত প্রমাণ। এই সংকট শুধু শিক্ষকদের জন্য নয়, যুব সমাজের জন্যও একটি বড় চ্যালেঞ্জ। যুবক-যুবতীদের এখনই সচেতন হয়ে শিক্ষা ও দক্ষতার পথে ফিরতে হবে। অর্থহীন রিল বা ফুড ব্লগিংয়ের মায়া ছেড়ে নিজের ভবিষ্যৎ গড়ার দায়িত্ব নিজেদের হাতে তুলে নিতে হবে। সরকারের উচিত দুর্নীতি বন্ধ করে শিক্ষা ব্যবস্থাকে পুনরুদ্ধার করা, যাতে আগামী প্রজন্ম একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ পায়।